অন্যান্য

তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প ।। কালো ধোঁয়ার ছায়ায় বরগুনার তালতলী

  প্রতিনিধি 28 May 2025 , 8:41:31 প্রিন্ট সংস্করণ

মোঃ শাহজালাল, বরগুনাঃ

তালতলী উপজেলার অংকুজানপাড়া গ্রাম এখন আর সেই চেনা গ্রাম নেই। এক সময় যেখানে বাতাস ছিল মুক্ত, যেখানে নদী ছিল শান্ত, সেখানে আজ বিষাক্ত ধোঁয়া, ক্ষতিকর পরিবেশ ও বিপন্ন জীবন ছাড়া আর কিছুই নেই।

কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদন শুরু হওয়ার পর, এখানকার প্রতিটি ধূলিকণায় যেন এক অবিরাম অভিশাপের ছায়া পড়েছে। ৩০৭ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রকল্পের বিদ্যুৎ উৎপাদন এখন আর আশার আলো নয়, বরং এক ভয়ানক কালো ধোঁয়ার বিষাক্ত ছায়া, যা গ্রামবাসীর জীবনকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

তালতলী গ্রামের ইদ্রিস আলী বলেন, ‘সরকার বিদ্যুৎ দিল, কিন্তু আমার মেয়ে কীভাবে বাঁচবে?’ পাঁচ বছরের সামিয়া মায়ের কোলে শুয়ে আছে, শরীরে চর্মরোগের কারণে বিভিন্ন জায়গায় লাল দাগ, কিন্তু ডাক্তার দেখানোর টাকা নেই। একসময় যেখানে বাতাস ছিল প্রাণবন্ত, সেখানে এখন বিষাক্ত কয়লার ধোঁয়া। এই ছোট্ট শিশু, এই মা, হাজারো মানুষের দিনযাপন শুধুই এক শ্বাসরুদ্ধকর যন্ত্রণা- তবে কোথাও নেই প্রশাসনের দৃষ্টি।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড ও পার্টিকুলেট ম্যাটারের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে ত্বক ও শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। শিশুদের জন্য এটি মারাত্মক, এমনকি বৃদ্ধরাও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। এমনটাই বলছেন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা।

তালতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক চিকিৎসক জানান, ‘গত দুই মাসে চর্মরোগী ও হাঁপানি রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।’ এখানে শুধু মানুষই নয়, প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যও আক্রান্ত।

মৎস্যজীবী মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘নদীতে আর মাছ নেই। কয়লার ধোঁয়া ও দূষিত পানি মাছের জন্য হুমকির সৃষ্টি করছে। কোনো জাল ফেললেই শুধু ময়লা আর মরা মাছ ওঠে।’ গ্রামে গ্রামে কৃষকরা বলছেন, ‘ফসল আর ভালোভাবে ফলছে না। দূষিত বাতাসে শরীর দুর্বল হয়ে গেছে, খেতের ফলন কমে গেছে গাছ মরে যাচ্ছে। আমাদের জমি আর আমাদের জীবিকা সবই হুমকির মুখে।

শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের শিক্ষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এই কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থ আমাদের নদী ও সাগরের পানির গুণমানকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। অ্যালুমিনিয়াম, মিথেন, সালফার ডাই-অক্সাইড ও ভারী ধাতু পানিতে মিশে জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য বিপদ তৈরি করছে। মাছের জীবনচক্র বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত করতে পারে।

পরিবেশ কর্মী মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, ‘কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করার আগে আমাদের জীবন ও পরিবেশের কথা ভাবা হয়নি।’ অথচ প্রশাসন, বিশেষজ্ঞ, সাধারণ মানুষ সবাই জানেন, এই প্রকল্পের শুরুতে বলা হয়েছিল বিদ্যুৎ আসবে, আলো ছড়াবে। কিন্তু কী মূল্য দিয়ে আসল সেই আলো? মানুষের জীবন, শ্বাসপ্রশ্বাস, স্বাস্থ্য- এবং মৎস্যজীবী ও কৃষকদের জীবিকা।

ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর তালতলী সমন্বয়ক মো. আরিফুর রহমান, বলেন, ‘আমরা বারবার প্রতিবাদ জানিয়েছি, মানববন্ধন করেছি, কিন্তু প্রশাসন কানে তুলছেন না। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিবেশের জন্য মারাত্মক, বিশেষ করে জলজ প্রাণী ও মানুষের জন্য।’

সরকারের আশ্বাস, জনগণের ক্ষোভ : তালতলী আজ কাঁদছে, কিন্তু আশার আলো কোথায়? স্থানীয়রা বলেন, ‘বিদ্যুৎ তো আসলো, কিন্তু আমাদের জীবন তো কেউ ফেরাবে না। সরকার কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার বিনিময়ে আমাদের জীবন কেন বিসর্জন দিতে হবে?’

উন্নয়ন বা মৃত্যু? : এই প্রশ্ন আজ তালতলীকে ঘিরে রেখেছে- ‘কয়লার বিদ্যুৎ চাই, নাকি বেঁচে থাকার অধিকার?’ সরকার উন্নয়ন চায়, কিন্তু যদি সেই উন্নয়নের বিনিময়ে মানুষের স্বাস্থ্য, জীবন এবং ভবিষ্যৎই বিলীন হয়ে যায়, তাহলে সেই উন্নয়ন কি সত্যিকার অর্থে প্রগতির সূচনা হতে পারে? এখন তালতলী গ্রামবাসী শুধু একটি শব্দেই রুদ্ধ হয়ে আছেন-‘বাঁচাও!’

মোঃ শাহজালাল
বরগুনা।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ