প্রতিনিধি 18 June 2025 , 2:56:54 প্রিন্ট সংস্করণ
❒ ইরানে নিহতের সংখ্যা ৪৫০ ছাড়িয়েছে গেছে-দাবি দেশটির একটি মানবাধিকার সংগঠনের
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি আবারও স্পষ্ট করেছেন, তার সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য—ইরানের শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতার কেন্দ্রকে সরিয়ে দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সরাসরি বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যা করলে সংঘাত বাড়বে না, বরং অবসান করবে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যার ইসরায়েলি পরিকল্পনায় ভেটো দিয়েছিলেন কি না, এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান নেতানিয়াহু।ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাতের চতুর্থ দিন সোমবার তেহরানের হাসপাতালগুলোতে রক্তাক্ত দৃশ্য ফুটে উঠছে। ইমাম খোমেনি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রবিবার সন্ধ্যায় একযোগে বহু আহত ব্যক্তি আসার পর পরিস্থিতি ‘রক্তস্নানে’ পরিণত হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চিকিৎসক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, চারপাশে শুধু চিৎকার, কান্না আর রক্ত। শুরুর দিকে আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না কাকে আগে বাঁচানো দরকার।নেতানিয়াহু বলেন, আমরা যা প্রয়োজন, সেটাই করছি। তাঁর কথায় ইঙ্গিত স্পষ্ট—ইসরায়েল ইরানকে দমন করতে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এই উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন কতটা জড়িত বা সহানুভূতিশীল?ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানে নিহতের সংখ্যা ৪৫০ ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির একটি মানবাধিকার সংগঠন। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৫২ জন নিহত ও ৬৪৬ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্টস ইন ইরান (এইচআরএনএ)। এইচআরএনএ’র বরাতে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে ২২৪ জন বেসামরিক নাগরিক, ১০৯ জন সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং আরও ১১৯ জন অজ্ঞাত পরিচয়ধারী। আহতদের মধ্যে রয়েছেন ১৮৮ জন বেসামরিক, ১২৩ জন সামরিক সদস্য এবং ৩৩৫ জনের পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।তেহরানে ইসরায়েলের প্রথম বিমান হামলার পরপরই ট্রাম্পপন্থি ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ শিবিরের দুই গুরুত্বপূর্ণ মুখ স্টিভ ব্যানন ও টাকার কার্লসন দাবি করেন, হোয়াইট হাউজের পদক্ষেপগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে ‘রেজিম পরিবর্তনের’ স্পষ্ট পরিকল্পনার দিকে।
ব্যানন বলেন, এটা শুধু পারমাণবিক অস্ত্র নয়, পুরো নেতৃত্ব কাঠামো ধ্বংসের পরিকল্পনা। কার্লসন যোগ করেন, আমি সবাইকে চিনি, আমি সত্য বলছি। এখানে কোনও উদ্দেশ্য লুকানো নেই। মূল বিষয়ই হচ্ছে রেজিম পরিবর্তন।
নেতানিয়াহু এবিসি-কে বলেন, আজ তেলআবিব, কাল নিউ ইয়র্ক। আমি বুঝি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। কিন্তু ‘আমেরিকা ডেড’ বোঝার কিছু নেই।
তবে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি, বিশেষ করে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সমর্থকরা নেতানিয়াহুর কথায় সায় দিচ্ছেন না। তাদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী হবে।
ইউরোপীয় ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনে রাষ্ট্রপ্রধানদের হত্যাচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই নিষিদ্ধ। কিন্তু ২০০১ সালের পর ‘ওয়ার অন টেরর’ নামের এক বিশেষ যুদ্ধনীতির আড়ালে এসব নিয়ম ভেঙে গুপ্ত হত্যা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে ইরান কোনও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয়, একটি রাষ্ট্র। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরান বিশ্লেষক সিনা আজোদি বলেন, ইসরায়েল যদি খামেনিকে হত্যা করে, তা এক দেশের বিরুদ্ধে আরেক দেশের সরাসরি যুদ্ধ হবে। আর ইরানে নেতৃত্ব কাঠামোও এককেন্দ্রিক নয়—সেখানে নতুন নেতা নির্বাচনের একটি পরিষদ আছে।
ইরাক কিংবা যুগোস্লাভিয়ার মতো দেশে বিমান হামলা বা নিষেধাজ্ঞা শাসনব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে পারেনি। একইভাবে ইরানে দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা কিংবা সাম্প্রতিক হামলাগুলোর পরও জনপ্রিয় বিদ্রোহ দেখা যায়নি।
সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিলান উইলিয়ামস বলেন, ট্রাম্প যখন কূটনৈতিক সমাধানের কথা বলেন, আবার নেতানিয়াহুকে যেভাবে ছাড় দিচ্ছেন। তা বিপরীত প্রভাব ফেলছে। ইরানে গণঅসন্তোষ না বাড়িয়ে বরং জাতীয়তাবাদ আরও উস্কে দিচ্ছে।
এক ইরানি-আমেরিকান ইহুদি নাগরিক বলেন, রেজিম পরিবর্তন প্রচারণা নিয়ে ইরানিদের মধ্যে কোনও সহানুভূতি নেই। বরং যারা সরকারের বিরোধী, তারাও এখন জাতীয় পতাকার চারপাশে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি এখনও কোনও সিদ্ধান্ত ঘোষণা না করলেও ইসরায়েলকে যে সমরাস্ত্র ও কূটনৈতিক সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তাতে অনেকেই মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র নীরব সহযোগিতা করছে।
মঙ্গলবার ট্রাম্প কয়েক তার ট্রুথ সোশ্যাল অ্যাপে এক পোস্টে দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবে জানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি কোথায় লুকিয়ে আছেন। তিনি একটি সহজ টার্গেট, কিন্তু সেখানে নিরাপদ। আমরা তাকে বের করে আনব না (হত্যা করব না!), অন্তত এখন নয়।
আরেক পোস্টে তিনি ইরানকে ‘বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ’ করতে বলেছেন।
উইলিয়ামস বলেন, যদি ইসরায়েল খামেনিকে হত্যার চেষ্টা করে পুরো বিশ্ব এটিকে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল যৌথ উদ্যোগ বলেই দেখবে।
তবে আজোদি মনে করেন, ট্রাম্প এখনও আলোচনার পথ বন্ধ করেননি। বরং ইরান যদি যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য মেনে নেয়, তাহলে তার শাসন কাঠামো নিয়ে ওয়াশিংটনের বিশেষ আপত্তি থাকবে না।
সূত্র: মিডল ইস্ট আই