প্রতিনিধি 9 July 2025 , 10:13:28 প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকা, ৯ জুলাই ২০২৫: গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া ছাত্র আন্দোলন দমনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রাণঘাতী দমন-পীড়ন চালানোর অনুমোদন দিয়েছিলেন—এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার কথা বলছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। তাদের আই ইউনিটের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ফাঁস হওয়া একটি অডিও টেপ যাচাই করে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
বিবিসি আই ইউনিট জানিয়েছে, চলতি বছরের মার্চে অনলাইনে ফাঁস হওয়া একটি অডিওতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে বলেন, “যেখানেই পাবে, গুলি করবে।” এই নির্দেশনার পর আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ:
এই ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং তখনকার পুলিশ কর্মকর্তারাও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামি হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ২০৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে, যার মধ্যে ৭৩ জন বর্তমানে কারাগারে আছেন।
ভয়াবহ যাত্রাবাড়ী ঘটনা:
বিবিসি আই তাদের অনুসন্ধানে গত বছর জুলাই-আগস্টে ৩৬ দিনের আন্দোলনের সময় বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের হামলার শত শত ভিডিও, ছবি ও নথিপত্র বিশ্লেষণ ও যাচাই করেছে। তাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ৫ আগস্টের একটি ঘটনায় পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫২ জন নিহত হয়েছিলেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘পুলিশি সহিংসতার অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঘটনার সময়কার প্রাথমিক প্রতিবেদনে যাত্রাবাড়ীতে ওই দিন ৩০ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
বিবিসি বলছে, তাদের অনুসন্ধানে এই সহিংসতার শুরু ও শেষ সম্পর্কে বিস্তারিত নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের তোলা ভিডিও, সিসিটিভি ফুটেজ এবং ড্রোন থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে বিবিসি আই নিশ্চিত হয়েছে যে পুলিশ বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অবস্থান নেওয়া সেনা সদস্যরা সরে যাওয়ার পরপরই পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি শুরু করে। গুলি শুরুর পর বিক্ষোভকারীরা মহাসড়ক এবং আশপাশের অলিগলি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেও পুলিশ টানা ৩০ মিনিট ধরে গুলি চালিয়ে যায়। পরবর্তীতে পুলিশ কর্মকর্তারা কাছের সেনা ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নেন।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভকারীরা যাত্রাবাড়ী থানায় হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়, যেখানে অন্তত ছয়জন পুলিশ সদস্য নিহত হন।
পুলিশের স্বীকারোক্তি ও তদন্ত:
বাংলাদেশ পুলিশের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, গত বছর জুলাই-আগস্টের সহিংসতার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মুখপাত্র স্বীকার করেন, “কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বাংলাদেশ পুলিশ ইতোমধ্যে পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করেছে।”
বিচার প্রক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, সাধারণ নাগরিকদের ওপর সহিংসতার নির্দেশ দেওয়া, উসকানি, ষড়যন্ত্র এবং হত্যা ঠেকাতে ব্যর্থতাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
ভারতকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার, কারণ তিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। তবে ভারত সেই অনুরোধে এখনো সাড়া দেয়নি। টবি ক্যাডম্যানের মতে, হাসিনা স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে বিচারের মুখোমুখি হবেন—এই সম্ভাবনা খুবই কম।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ বরাবরই বলে আসছে, বিক্ষোভকারীদের ওপর বলপ্রয়োগের দায় তাদের নেতাদের ওপর বর্তায় না। আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, “দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা কিংবা প্রধানমন্ত্রী নিজে জনতার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন—এমন দাবি আওয়ামী লীগ স্পষ্টভাবে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করছে। প্রাণহানি কমানোর জন্যই জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তারা ইতিবাচক বিশ্বাস থেকে ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং তা ছিল যৌক্তিক।”
জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশন জানিয়েছে, বিক্ষোভ দমনে শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের কর্মকাণ্ড মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে, সে বিষয়ে যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ তারা পেয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ তাদের এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিবিসি এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা কোনো জবাব দেয়নি।