প্রতিনিধি 13 July 2025 , 2:54:29 প্রিন্ট সংস্করণ
মনিরামপুরে ‘টাকার বিনিময়ে’ ভুয়া প্রতিবন্ধী কার্ডের ছড়াছড়ি: প্রকৃত প্রতিবন্ধীরা বঞ্চিত!
যশোর, মনিরামপুর: যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলায় ভুয়া প্রতিবন্ধী কার্ডের রমরমা বাণিজ্য ফাঁস হয়েছে, যা নিয়ে এলাকায় তীব্র তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সাবেক সংরক্ষিত মহিলা সদস্য এবং যুব মহিলা লীগ নেত্রী নিগার সুলতানা হীরা টাকার বিনিময়ে সুস্থ ও সক্ষম ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধী কার্ড করে দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, যার ফলে প্রকৃত প্রতিবন্ধীরা সরকারের এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নেহালপুর ইউনিয়নে এই জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় স্থানীয়দের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
‘আমি তো সুস্থ মানুষ, টাকা দিলে কার্ড করে দেবে জানতাম না’
নেহালপুর ইউনিয়নের শিউলি রানী দে, একজন সাধারণ গৃহবধূ, তার চোখে নেই কোনো অসহায়ত্ব, অথচ তার নাম এখন সরকারি প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ডের তালিকায়। তাকে দেখানো হয়েছে ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী’। হতবাক শিউলি রানী জানান, “আমি তো সুস্থ মানুষ, তারপরও হীরা মেম্বার বলল, টাকা দিলে একটা কার্ড করে দেবে। কিন্তু যে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেবে তা জানতাম না।” তার এই ভুয়া কার্ড করে দিতে হীরা মেম্বার তার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।
শুধু শিউলি রানীই নন, নেহালপুর ইউনিয়নের সাজেদা বেগম, কহিনুর বেগম, খলিলুর রহমান, শাহিনারা খাতুন পান্না, খালেক মোল্যা এবং তহমিনা বেগমসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধেই একই অভিযোগ উঠেছে। তাদের কেউই প্রতিবন্ধী নন, অথচ তাদের নাম এখন সরকারি প্রতিবন্ধীর খাতায়।
২০২৪ সালের তালিকায় অর্ধেকই ভুয়া?
সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে নেহালপুর ইউনিয়নে নতুন প্রতিবন্ধী তালিকাভুক্ত করা হয় ৮১ জনকে। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, এই তালিকার প্রায় অর্ধেকই সুস্থ ও সক্ষম ব্যক্তি, যারা অর্থের বিনিময়ে কার্ড পেয়েছেন। মনিরামপুর উপজেলা সমাজসেবা অফিস দাবি করেছে, প্রায় সাড়ে তিনশ আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের পর ৮১ জনের নাম নতুন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে তাদের সুবর্ণ নাগরিক কার্ড দেওয়া হয়েছে। তবে অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য সেবা কেন্দ্রে কর্মরত আসাদুল হক চঞ্চল, ইউপি সদস্য শাহিদুল ইসলাম, সংরক্ষিত মহিলা সদস্য লাকি খাতুন ও আলেয়া বেগম। তারা জানান, এই তালিকা তৈরিতে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না এবং হীরা মেম্বার ক্ষমতার দাপটে ও টাকার লোভে এই ভুয়া কার্ডগুলো তৈরি করেছেন।
টাকার বিনিময়ে কার্ড, অস্বীকার হীরা মেম্বারের
ভুক্তভোগী সাজেদা বেগম জানান, “হীরা মেম্বার আমার কাছ থেকে জরিপ ও অনলাইন খরচের কথা বলে ৪ হাজার টাকা নিয়েছেন। বলেছিলেন কার্ড করে দেবেন। কিন্তু প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেবেন তা জানতাম না।” তিনি সাংবাদিকদের সামনে দৃঢ়ভাবে স্বীকার করেন যে তিনি প্রতিবন্ধী নন। শাহিনারা খাতুন পান্নার স্বামী আবুল কালাম আজাদ বলেন, “পন্না কোনো প্রতিবন্ধী না। ৩ হাজার টাকা নিয়ে হীরা মেম্বার পান্নাকে কার্ড করে দিয়েছেন।” এমনকি তালিকার ৩৯ ও ৪০ নম্বর সিরিয়ালের খালেক মোল্যা ও তহমিনা বেগম স্বামী-স্ত্রী দু’জনই সম্পূর্ণ সুস্থ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক সংরক্ষিত মহিলা সদস্য এবং যুব মহিলা লীগ নেত্রী নিগার সুলতানা হীরা কার্ড তৈরিতে টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, “শিউলি রানী দে, সাজেদা বেগমসহ বেশ কয়েকজনের কাগজপত্র আমি সমাজসেবা অফিসে জমা দিয়েছিলাম। পরে যাচাই-বাছাই করে সমাজসেবা অফিস তাদের কার্ড দিয়েছে, এতে আমার করার কী আছে।”
প্রশাসনের দ্বারস্থ হওয়ার দাবি
নেহালপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত প্যানেল চেয়ারম্যান শওকত সরদার বলেন, “সাবেক মহিলা মেম্বার হীরা সমাজসেবা অফিস ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার অফিসের লোকদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন। আমি তাকে বহুবার নিষেধ করেছি, কিন্তু তিনি শোনেননি।”
মনিরামপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, তিনি সদ্য যোগদান করেছেন এবং শুনেছেন প্রায় চারশ আবেদনের মধ্যে ৮১ জনকে বাছাই করা হয়েছে। এই তালিকার অনুমোদন দিয়েছেন প্যানেল চেয়ারম্যান শওকত সরদার। তিনি আরও বলেন, “প্রতিবন্ধী নন এমন কেউ যদি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে, তবে অভিযোগ পেলে যাচাই-বাছাই করে তাদেরকে বাদ দেওয়া যাবে।”
এলাকাবাসী এবং ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জি এম খলিলুর রহমান সমাজসেবা অফিসের কাছে দাবি জানিয়েছেন, পুনরায় তদন্ত করে প্রকৃত প্রতিবন্ধীদের হাতে যেন ভাতা পৌঁছায়, এবং এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই ঘটনা স্থানীয় সুশীল সমাজ ও সচেতন নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে এবং তারা দ্রুত এর প্রতিকার দাবি করছেন।
এই ধরনের ঘটনাগুলো সমাজে প্রকৃত অসহায় ও দুস্থ মানুষেরা যারা সুবিধা পাওয়ার যোগ্য, তাদের অধিকার হরণ করে। আশা করি, আপনার এই নিউজটি স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং এ বিষয়ে একটি সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।