অন্যান্য

পানিতে ভাসছে চৌগাছার ফুলসারা: অসহায়ত্বের মাঝে আনন্দ ভ্রমণ!

  প্রতিনিধি 21 July 2025 , 12:10:46 প্রিন্ট সংস্করণ

জেমস আব্দুর রহিম রানা: যশোরের চৌগাছা উপজেলার ফুলসারা ইউনিয়ন এখন এক ভিন্ন পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি। কয়েকদিনের টানা ভারী বৃষ্টিতে এখানকার একাধিক গ্রামের ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, মাছের ঘের সবই তলিয়ে আছে হাঁটুপানি বা তারও বেশি গভীরতায়। একদিকে যখন হাজারো মানুষ ঘরছাড়া, ফসলের মাঠ ভেসে গেছে আর মাছের ঘেরের স্বপ্ন বিলীন, ঠিক তখনই এক শ্রেণির উচ্চাভিলাষী মানুষের ঢল নেমেছে এই বন্যাকবলিত এলাকায়। তাদের কাছে এটি যেন ‘চৌগাছার কক্সবাজার’ বা ‘কুয়াকাটা’, যেখানে চলছে দেদারসে সেলফি ও ভিডিও তোলার উৎসব!

সরেজমিনে দেখা গেছে, সলুয়া, রানীয়ালু, হাউলি, বাড়িয়ালী, দুড়িয়ালী, দশপাখিয়া, কালিয়াকুড়ি-সহ বহু গ্রামের মাঠের পর মাঠ এখন অথৈ পানির নিচে। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার বেহাল দশা এবং সময় মতো ছোট কালভার্ট ও খালগুলো খনন না হওয়ায় এই ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।

বানের জলে ভেসে যাওয়া মাছের ঘেরের ধারে দাঁড়িয়ে কৃষক আব্দুল মালেক যখন অসহায় চোখে তার ডুবে যাওয়া স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে শুধু বলছিলেন, “এই ঘেরটাই ছিল ভরসা। ধার করে মাছ ছেড়েছিলাম। সব গেল। এখন খালি পানি আর কান্না”, ঠিক তখনই তার পাশেই দেখা যাচ্ছিল সেলফি-উন্মত্ত জনতার ভিড়। কেউ ছবি তুলছে, কেউ ভিডিও করে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে, আর কেউ লিখছে “চৌগাছার কক্সবাজারে ঘুরতে এলাম।”

বাড়িয়ালী গ্রামের কৃষক আমিন হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের এবার মরণ ছাড়া উপায় নেই। হাজার হাজার বিঘা জমিতে এবার আর ধান চাষ সম্ভব হবে না। পানিবন্দি মানুষ যখন অসহায়ের মতো জীবন যাপন করছে, তখন তাদের সামনেই একশ্রেণির মানুষ সেলফি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। এটা রীতিমতো কারোর সর্বনাশ, কারো আবার পৌষ মাসের মতো!”

ঘুরতে আসা শিমুল হোসেন নামের একজন যুবককে এই প্লাবিত এলাকায় আসার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি হেসে উত্তর দেন, “অসাধারণ একটা সৌন্দর্য! পানির মধ্যে ঘরবাড়ি, গাছের মাথা দেখা যাচ্ছে, দেখতেই মন ভালো হয়ে যায়। এমন জায়গা তো সবসময় দেখা যায় না।”

কিন্তু তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবাসী রাবেয়া খাতুনের চোখে তখন গড়িয়ে পড়ছে পানি। তিনি মর্মাহত কণ্ঠে বললেন, “আমরা ডুবে যাচ্ছি, তারা এসে ছবি তোলে। কারও কান্না এখানে কারও হাসির বিষয় হয় কীভাবে?”

এই দৃশ্যপট যেন দুই ভিন্ন পৃথিবীর অস্তিত্ব জানান দেয়—একপাশে হারানোর বেদনায় ডুবে থাকা মানুষ, আর অন্যপাশে সেই বেদনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কারও আনন্দ ভ্রমণ।

স্থানীয় সমাজকর্মী আহসান হোসেন এই বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “মানুষ এখানে আসতে পারে, কিন্তু যেন অন্তত একটু সহমর্মিতা থাকে। যারা ভাসছে, তাদের কষ্টটাও যেন দেখা হয়।” তিনি আরও যোগ করেন, “আসলে আমরা কীভাবে এমন পরিস্থিতির দিকে তাকাই, তা-ই বলে দেয় আমাদের মন কতটা মানবিক। একজনের দুর্যোগ যদি আরেকজনের উৎসব হয়ে ওঠে, তাহলে সমাজের চোখে কি আমরা কিছুটা অন্ধ হয়ে যাচ্ছি না?”

সরেজমিন এলাকায় এখনও দেখা যাচ্ছে ঘরবাড়ি, কৃষকের ফসল, আর মাছের ঘের পানির নিচে ডুবে আছে। এর মধ্যেই আবহাওয়া অফিস আবারও ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে, যা এখানকার পানিবন্দি মানুষদের চোখে মুখে আরও অন্ধকার নামিয়ে এনেছে।

তবে চৌগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুসাব্বির হোসাইন জানিয়েছেন, বৃষ্টির পানি নামার সাথে সাথেই কৃষকরা যাতে ধান রোপণ করতে পারে, কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তাদের সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।

এই সংকটময় পরিস্থিতিতে মানবিকতা ও সহমর্মিতার বার্তা কতটা মানুষের মনে পৌঁছায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ