অন্যান্য

সিন্ডিকেটের বাগড়া, কলাপাড়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু নিয়ে অনিশ্চয়তা

  প্রতিনিধি 20 August 2025 , 8:25:41 প্রিন্ট সংস্করণ

কলাপাড়া প্রতিনিধি:

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় কয়লাভিত্তিক বৃহৎ তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে দীর্ঘমেয়াদে কয়লা সরবরাহের জন্য চতুর্থ দফায় ডাকা দরপত্র আবারো বাতিল করা হয়েছে। দরপত্রে কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নের বিভিন্ন ধাপে অনিয়ম ও ত্রুটি রয়েছে উল্লেখ করে এটি বাতিল করা হয়। এর আগে তিন দফায় কেন্দ্রটির জন্য দীর্ঘমেয়াদি কয়লার দরপত্র ডেকেও কোনো কোম্পানি চূড়ান্ত করতে পারেনি যৌথভাবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান- আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড (আরএনপিএল)। চতুর্থ দফায় দরপত্র বাতিলের মধ্যদিয়ে বৃহৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং সরকার লোকসানের মুখে পড়ছে।অভিযোগ রয়েছে, বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর নির্ধারিত সময় পার হলেও পুরনো ‘সিন্ডিকেটের’ বাধায় কয়লার সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড (আরএনপিএল) কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি কোম্পানি যোগ্য বিবেচিত হলেও একটি ‘সিন্ডিকেটের’ সঙ্গে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে’ না আসায় বার বার তাদের সঙ্গে দরপত্র বাতিল করা হচ্ছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার অনেকটা তড়িঘড়ি করে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ওই প্রতিষ্ঠানকে দরপত্র বাতিল করে চিঠি দিয়েছে আরএনপিএল। যদিও এক্ষেত্রে আরএনপিএল পরিচালন পর্ষদের বোর্ডের কোনো অনুমোদনই নেয়া হয়নি। বোর্ড সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, বোর্ডে উপস্থাপন ও অনুমোদন ছাড়াই দরপত্র বাতিলের এমন সিদ্ধান্ত খুবই রহস্যজনক ও নজিরবিহীন।সূত্র মতে, দরপত্র অনুযায়ী শর্ত পূরণ করে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়াংথাই এনার্জি পিটিই লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি যোগ্য বিবেচিত হলেও স্থানীয় কোম্পানিগুলোর চাপে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর আগেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে দফায় দফায় শর্ত শিথিল করা হয়েছিল। এরপরও সিন্ডিকেটের পছন্দের কোম্পানি না আসায় শর্ত শিথিলের কথা বলা হচ্ছে। যদিও সর্বশেষ মূল্যায়ন আর্থিক প্রতিবেদনে ইয়াংথাই এনার্জি প্রস্তাবিত দরকে সাশ্রয়ী বলে গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নথিপত্রে উল্লেখ আছে, কয়লার মান ও অ্যাশ ফিউশন আরও কমানো হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিজাইন অনুযায়ী বয়লার তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার কিলোক্যালরি কম হলে তাতে জ্বালানি ব্যয় বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।আরএনপিএল সূত্রে জানা গেছে, আরএনপিএলের ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি রয়েছে। ১৪ বছর মেয়াদি এই ঋণচুক্তির মধ্যে চার বছর গ্রেস পিরিয়ড। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এই ঋণ চুক্তি হয়। চুক্তির শর্তে বলা হয়, প্রকল্প শেষ হওয়ার ছয় মাস পর থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। চলতি বছরের এপ্রিলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এবং পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হলেও ২৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলছে। সূত্র জানায়, কেন্দ্রটি থেকে প্রতি মাসে সাড়ে ১০ মিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। ২৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলছে অন্তত সাড়ে ৭ মিলিয়ন ডলারের (জ্বালানি খরচ বাদে) বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। এতে কেন্দ্রের আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে।অভিযোগ উঠেছে, চতুর্থ ধাপের দরপত্রের কার্যক্রম চলাকালীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম ভূঁইয়া সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানিটির একজন কর্মকর্তাকে বর্তমান সরকারের বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির নম্বর পাঠিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। প্রভাবশালী ওই ব্যক্তি বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি ও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বোর্ডের সদস্য। প্রভাবশালী ওই ব্যক্তি নিজেই দরদাতা সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাকে মেসেজ পাঠিয়ে আরএনপিএল ইস্যুতে তাদের সঙ্গে আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে আসার কথা জানান। এজন্য একদিনের সময় বেঁধে দেয় ওই প্রভাবশালী। যদিও ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে’ না যাওয়ায় মঙ্গলবার সিঙ্গারভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটিকে চিঠি দিয়ে দরপত্র প্রক্রিয়া বাতিলের কথা জানিয়ে দিয়েছে আরএনপিএল।যদিও চতুর্থ দফায় ডাকা দরপত্রের কারিগরি মূল্যায়নে ইয়াংথাই এনার্জিকে যোগ্য ঘোষণা করা হয়। বাকি তিনটি কোম্পানিকে অযোগ্য ঘোষণা করে আর্থিক প্রস্তাবনা ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ইয়াংথাই এনার্জির আর্থিক প্রস্তাবটি মূল্যায়নে তিনটি সভা করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। আর্থিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে ইয়াংথাই এনার্জির প্রস্তাবিত কয়লার দর সাশ্রয়ী উল্লেখ করে তা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ২৯শে জুন অনুষ্ঠিত আরএনপিএলের বোর্ড সভায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম ভূঁইয়া প্রকিউরমেন্ট সত্তার প্রধানের (হোপ) পদাধিকার ক্ষমতাবলে প্রস্তাবটি পুনরায় মূল্যায়নের জন্য কারিগরি কমিটির কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দেন। অভিযোগ করা হয়, কমিশনিংয়ের কয়লার দামের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদে কয়লা সরবরাহের প্রস্তাবিত দর বেশি।আরএনপিএলের বোর্ড সভায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কয়লার দর তুলনা করা হয়। কমিশনিংয়ের কয়লার দরের (আইসিআই-৩ ইনডেক্স অনুসরণকৃত) চেয়ে চতুর্থ দফায় কয়লার প্রস্তাবিত দর (এইচবিএ ইনডেক্স অনুসরণকৃত) তুলনা করে প্রতি টন কয়লার মূল্যে ৮৪ সেন্ট বেশি পাওয়া গেছে বলে ব্যাখ্যা করা হয়। যদিও দরপত্রের আর্থিক প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে এইচবিএ ইনডেক্স অনুসরণের বিষয়টি নির্ধারণ করে বিপিডিবি, মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। আর্থিক মূল্যায়নের পরও এমডি সেলিম বিষয়টি আটকে রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমডি বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পক্ষ থেকে কয়লার দর নিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। যদিও পিপিআর আইন অনুযায়ী, মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চলাকালে সমঝোতার সুযোগ নেই।বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, কলাপাড়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারায় ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পড়ে রয়েছে। উৎপাদন করতে পারছে না। ডাবল লস হচ্ছে। এটি যদি চলতো, আমরা যে বিদ্যুৎ পেতাম তা আমরা গ্যাস দিয়ে উৎপাদন করতে পারছি না। আমাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকে গ্যাসগুলো আমরা শিল্পে ব্যবহার করতে পারি। এই কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কয়লা আমদানি করতে না পারা ব্যর্থতা। এটা গভর্ন্যান্সের সমস্যা। কয়লা আমদানি হচ্ছে না, বারবার দরপত্র বাতিল হচ্ছে এটা তাদের সক্ষমতার অভাব। অন্যসব পাওয়ার প্লান্টের জন্য যদি কয়লা পাওয়া যায়, এখানে কেন যাবে না। আমাদের চার-পাঁচটা পাওয়ার প্লান্ট চলছে, এখানে সম্ভব কেন হচ্ছে না।এই বিষয়ে কথা বলতে আরএনপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. নাজমুস সায়াদাত-এর সঙ্গে মানবজমিনের পক্ষ থেকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি সাড়া দেননি।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ