প্রতিনিধি 26 August 2025 , 12:35:24 প্রিন্ট সংস্করণ
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নে সব রাজনৈতিক দল একমত। তবে সেই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনীতিতে দুটি বিপরীত ধারা তৈরি হয়েছে, যা ক্রমেই দুই মেরুর রাজনীতির দিকে এগোচ্ছে। সংবিধানে জুলাই সনদের প্রাধান্য এবং আদালতে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন না তোলার বিধান রেখে প্রস্তাব দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। আর নির্বাচনের আগেই সংস্কার বাস্তবায়ন এবং এ জন্য গণভোট ও নতুন সংবিধানের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের পক্ষে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে জুলাই সনদের উল্লিখিত দুটি বিধান এবং জামায়াত-এনসিপির অবস্থানের বিপরীতে রয়েছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। তারা চাইছে, অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার নির্বাচনের আগেই করা যেতে পারে। আর সাংবিধানিক সংস্কার করবে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ।বিএনপি ও এর সমমনা দল এবং জামায়াত ও এনসিসির এই বিরোধপূর্ণ অবস্থানের মধ্যেই গতকাল সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা জানিয়েছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দেশ প্রস্তুত। গতকাল কক্সবাজারে এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিগত সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে এক বছর আগে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞ এবং ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর বর্তমানে দেশ যথেষ্ট স্থিতিশীল এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে এবং এই নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।জুলাই সনদ ও সংস্কার বাস্তবায়ন ছাড়া নির্বাচন বয়কটের হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছে এনসিপি। গত রবিবার মালয়েশিয়ায় এক অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, গত এক বছর ধরেই আমরা নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলে আসছি। এ দাবি পূরণ না হলে জনগণ জাতীয় নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করবে। তাই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির মাধ্যমে আমরা আগে গণপরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাই।
দলগুলোর অনড় অবস্থানের মধ্যে জুলাই সনদ চূড়ান্তকরণের পথ খুঁজছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছে। যদিও এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
এদিকে সংবিধানে জুলাই সনদকে প্রাধান্য ও আইন চ্যালেঞ্জ করা যাবে না- এমন প্রস্তাবকে উদ্ভট বলে মনে করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, যদি গায়ের জোরে চালাতে চান, তাহলে এখন চালাতে পারেন। তবে এগুলো আইনিভাবে টিকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তিনি আরও বলেন, আমার কাছে পুরো এই জিনিসটা, এই ধরনের উদ্ভট কথাবার্তা আমি বহু বছর শুনিনি।ড. শাহদীন মালিক বলেন, জুলাই সনদ একটা অঙ্গীকার। এটা কার্যকর করার একটা প্রতিজ্ঞা থাকবে, দায়বদ্ধতা থাকবে। কিন্তু এটাকে আইন হিসেবে গণ্য করার কোনো উপায় দেখছি না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। আপনি উদ্ভট কথাবার্তা বলবেন আর তাতে নির্বাচন অনিশ্চয়তায় পড়বে- এমন মনে করলে তো দেশে কখনই নির্বাচন হবে না।
জুলই সনদে আইনি ভিত্তি ছাড়া এনসিপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা প্রসঙ্গে শাহদীন মালিক বলেন, সাড়ে ১২ কোটি ভোটারের মধ্যে তাদের ভোটার কত জন? নিবন্ধিত ১০টি দল নির্বাচনে না এলে যে নির্বাচন হবে না, তা কিন্তু নয়। এখন বাক-স্বাধীনতা আছে, সবাই সব কিছু বলতে পারে।
গত রবিবার ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞদের সংলাপে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জানা গেছে, আলোচনায় সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের মতামত নিতে রেফারেন্স পাঠানো যায় কি না- এমন প্রস্তাব আসে। তাতে বেশিরভাগ মত বিপক্ষে যায়। তারা বলেন, সরকার গঠিত হয়েছে আপিল বিভাগের রেফারেন্স নিয়ে। আবার সনদ করতে আপিল বিভাগের রেফারেন্স চাওয়া ঠিক হবে না। ফলে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।কমিশন সূত্র জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহে ফের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসবে ঐকমত্য কমিশন। সেখানে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হবে।
লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, দলগুলো যদি মতপার্থক্য থাকার পরও স্বাক্ষর করে তাহলে নির্বাচনের পর তা গুরুত্ব হারাতে পারে। সেটা তখন একটি কাগুজে বাঘ হয়ে থাকতে পারে।
জুলাই জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে এখন পর্যন্ত ২৬টি দল মতামত দিয়েছে। এতে সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে দেখা দিয়েছে মতপার্থক্য। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়া না দেওয়ার প্রশ্নেই বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপির মূল বিরোধ।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই হচ্ছে রাজনৈতিক সমঝোতা দলিল। কোনো সমঝোতা দলিলকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে অবস্থান দেওয়া যায় না। সেটা করা হলে খারাপ নজির তৈরি হবে। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন যদি জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পথ নিয়ে আবারও আলোচনায় বসতে চায়, আমরা আন্তরিকভাবে অংশ নেব। বৈধ আইনি ও সাংবিধানিক উপায়ে বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনায় ঐকমত্য এলে বিএনপি সেটির প্রতি সমর্থন জানাবে।
গণভোট ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবির বিষয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা আলোচনায় বসতে আগ্রহী। আলোচনায় যে ফলাফল বা ঐকমত্য আসবে, সেই অনুযায়ী জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে বিএনপি অঙ্গীকারবদ্ধ।অন্যদিকে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে গণভোট আয়োজনের দাবি তুলেছে জামায়াতে ইসলামী। দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে। না হলে এ আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না। অতীতে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে যেভাবে গণভোট ও প্রোক্লেমেশন সাংবিধানিক মর্যাদা পেয়েছিল, একইভাবে জুলাই সনদকেও আইনি বৈধতা দিতে হবে। তিনি বলেন, কেউ কেউ বলছেন, সংসদে গিয়ে আইন করা যাবে, এটা অবাস্তব। কারণ পরবর্তী সংসদ যদি পুরনো নিয়মে নির্বাচিত হয়, তবে সংস্কার কার্যকর হবে না।
জুলাই সনদ নিয়ে দলগুলোর অনড় অবস্থান সত্ত্বেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিশ্বাস, আইনসম্মত উপায়ে সমাধান বের করা সম্ভব হবে।
ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে যেন সত্যিকার অর্থে একটি ঐকমত্য তৈরি হয়। আমরা কেউ নিশ্চিত নই, তবে সবাই আশাবাদী।
সুত্র: আমাদের সময়