অন্যান্য

সুন্দরবনের ত্রাস এখন জেল পলাতক আসামিরা

  প্রতিনিধি 11 November 2024 , 11:40:21 প্রিন্ট সংস্করণ

 

মাহতিম আহমেদ রাজা

 

দীর্ঘদিন শান্ত থাকার পর ফের অশান্ত হয়ে উঠেছে সুন্দরবন। জীবিকার তাগিদে বনের ভেতরে যাওয়া জেলেদের আটক করে মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে। অস্ত্রধারী দস্যুদের এমন অবাধ বিচরণে বনজীবীদের মনে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে একাধিক অভিযান চালিয়ে অপহরণের শিকার জেলেদের উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। অভিযোগ উঠেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় জেল পালানো আসামিরা দস্যুদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বন বিভাগের পক্ষ থেকে টহল জোরদারের কথা বলা হলেও ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নজরদারির অভাবে এমনটি হচ্ছে। প্রশাসন কঠোর হলে বনদস্যুদের উৎপাত কমে যেত বলে বনজীবিদের ধারণা।

জানা যায়, ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনের ছয় দস্যুবাহিনীর ৫৪ জন সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অঙ্গীকার জানিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। তৎকালীন সরকার ওইদিনই সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করে। এরপর থেকে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে। তবে পট পরিবর্তনের পর সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে বিভিন্ন অপরাধী চক্রের কার্যক্রম ফের বাড়তে থাকে।

বনজীবীরা জানান, রাতে জঙ্গলের মধ্যে আওয়াজ শোনা যায়। এছাড়া অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের শ্যামনগরে বনদস্যুদের আতঙ্ক বেশি তৈরি হয়েছে। এখানে নতুন নতুন বাহিনী গড়ে উঠেছে। ধারালো অস্ত্র ও বন্দুক নিয়ে তারা বনজীবীদের ওপর হামলা করছেন। এসব বাহিনী ফিল্মি স্টাইলে হামলা চালিয়ে জেলেদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের দাবি, জেল পলাতক আসামিরা এই দস্যুতার সঙ্গে জড়িত।

সাতক্ষীরা জেলা কারাগার সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে কারাগারে ২৩৬ জন কয়েদি-হাজতি রয়েছেন। এরমধ্যে পুরুষ ২২২ জন, নারী ১৪ জন। ৫ আগস্ট কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ৮৭ বন্দির মধ্যে ২৫ জন এখন সেখানে আছেন। অনেকে জামিন পেয়েছেন। তবে পলাতক আছেন ৫৩জন।

ভারপ্রাপ্ত জেল সুপার এনায়েতউল্যা জানান, পলাতক আসামিদের তালিকা বিভিন্ন দফতরে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে।

সম্প্রতি মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা ও বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গহীন বনে মাছ ও কাঁকড়া শিকারে যাওয়া জেলেদের কাছ থেকে দস্যুরা সবকিছু লুটে নিচ্ছে। চাচ্ছে বিপুল অঙ্কের চাঁদা। ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণ করা মঞ্জু বাহিনী ও সম্প্রতি জেল পলাতক আবদুল্লাহ তরফদার নতুন বাহিনী গঠন করে জেলেদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন। মুক্তিপণ আদায় করছেন। তাদের কাছে রামদা, বন্দুক, দা, কুড়াল ও লাঠি থাকে।

স্থানীয়রা জানান, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামের আকবর তরফদারের ছেলে আব্দুল্লাহ তরফদার (৪২) গত ১৪ জুলাই নারী পাচার মামলায় জেলে যান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট রাতে সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ভাঙচুর হলে সেখান থেকে পালিয়ে কৈখালী ইউপির পরাণপুর গ্রামে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ৬ আগস্ট রাতে স্থানীয় কয়েকজন দুষ্কৃতকারীর সহযোগিতায় মিরগাং মোড় দিয়ে তিনি সুন্দরবনে ঢোকেন। আব্দুল্লাহ তরফদারের সঙ্গে ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল ছিল। তাদের অধিকাংশই কারাগার থেকে পালিয়ে আসা এবং তাদের বাড়ি সাতক্ষীরা সদর ও কালিগঞ্জ উপজেলার মৌতলা এলাকায়।

বনজীবীদের ভাষ্য, ডাকাত দলগুলো গত ৫ আগস্টের পর সুন্দরবনে আবারো সক্রিয় হয়েছে। জেল ভেঙে পালানো দণ্ডপ্রাপ্তসহ এই আসামিরা সুন্দরবনের তক্তাখালি, চুনকুড়ি, দারগাং, আঠারোবেকী, কাচিকাটা, রায়মঙ্গল, কচুখালী, মাওন্দো নদী এলাকায় লুটপাট করছে। তারা জেলেদের নৌকায় যা পাচ্ছে সব নিয়ে নিচ্ছে। পুনরায় বনে ঢুকলে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হবে বলে হুঁশিয়ার করছে।

বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া শ্যামনগরের চুনকুড়ি গ্রামের জেলে নজরুল ইসলাম বলেন, ৩১ অক্টোবর সকালে চুনকুড়ি নদীর ধানুখালি এলাকা থেকে দুইজন ডাকাত আমাকে তুলে নেয়। আমার সঙ্গে থাকা অন্য জেলেরা মুক্তিপণের টাকা দেওয়ায় তাদেরকে ছেড়ে দেয়। শুরুর দিন থেকেই তারা আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। পরে ৩ নভেম্বর সকালে বন বিভাগের কর্মীরা অভিযান চালিয়ে আমাদের উদ্ধার করেন।

একই উপজেলার হরিনগর গ্রামের মফিজুর রহমান জানান, তাকে ৩১ অক্টোবর দুপুরে তক্তাখালী এলাকা থেকে বনদস্যুরা তুলে নেয়। পরে বন বিভাগের অভিযানে তাকে উদ্ধার করা হয়।

সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা সাতক্ষীরার গণমাধ্যমকর্মী পীযূষ বাউলিয়া পিন্টু মনে করেন, বনদস্যুদের পুনর্বাসনের পদক্ষেপ ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু নজরদারি ও তদারকি না থাকায় দস্যুদের উৎপাত আবারো বেড়ে গেছে। জেল পলাতক আসামিরা দস্যুদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকে অবশ্যই সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে।

পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক ইকবাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, আমাদের অভিযান চলছে। সাদা পোশাকে আমাদের বিভাগের সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। বর্তমানে বনের পরিবেশ স্বাভাবিক রয়েছে।

সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর সার্কেল) আমিনুর রহমান জানান, জেল পলাতক আসামিদের সমন্বয়ে সুন্দরবনে দস্যুবাহিনী গড়ে উঠার বিষয়টি তিনি জানতেন না। বিষয়টি নিয়ে বন বিভাগ তাদেরকে কিছু জানায়নি।তিনি বলেন, খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেল পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করতে সুন্দরবনে ফের অভিযান চালানো হবে বলে জানান তিনি।

আরও খবর

                   

জনপ্রিয় সংবাদ